মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৯

মৃত্যুদন্ড বাতিল করুন

ভয় দেখিয়ে কাউকে কোন কিছু করা থেকে বিরত রাখা যায় না। এই কথাটা মাথায় গেথে নিয়ে লেখাটি পড়া শুরু করুন। 
ইতিহাস - প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীতে অপরাধের শাস্তি হিসেবে বিশেষত হত্যার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের বিধান আছে। 1800 সালের মধ্যে ব্রিটেনে 200 টা অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ডের বিধান ছিল। ইসলামিক শরিয়া আইন অনুযায়ী মৃত্যুদন্ড একটি প্রচলিত শাস্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই বিভিন্ন মানবতাবাদী লেখক, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারকগণ মৃত্যুদন্ডের বিরোধীতা করতে শুরু করেন। এটা মানবতাবিরোধী, অমানবিক ও অধঃপতিত একটা শাস্তি। 1948 সালে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষনাপত্র জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত হবার পর 8 টা দেশ অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের আইন বাতিল করে। 1977 সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় 16 তে। 2015 সাল পর্যন্ত পৃথিবীর 140 টা দেশ মৃত্যুদন্ডের আইন বাতিল করে। 
মৃত্যুদন্ডের শাস্তি মানেই রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিকের বেঁচে থাকার অধিকার হরন করা। এ দন্ড সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষনাপত্রের দু'টি বিধানকে লঙ্ঘন করে। প্রথমটা হল - জীবন ধারনের অধিকার। দ্বিতীয়টা হল - অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। 1973 সালে যুক্তরাষ্ট্রে 150 জন বন্দীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় যারা পরবর্তীতে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন। অনেক মৃত্যুদন্ডের ক্ষেত্রে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রধান ভূমিকা পালন করে যা অত্যাচার করার মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়। সমাজের দরিদ্র শ্রেণী, সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বেশী মৃত্যুদন্ডের শিকার হয় বিচার নিরপেক্ষতার অভাবে। দেশে মৃত্যুদন্ডের আইন রাখা মানবিক আদর্শের পরিপন্থী।  
 
মৃত্যুদন্ডের পক্ষে যুক্তি: প্রত্যেক মানুষের বাঁচার অধিকার আছে। যারা সজ্ঞানে একজন মানুষের বাঁচার অধিকার হরণ করে তারা নিজেদের বেঁচে থাকার অধিকারও হারায়। মৃত্যুই তার যথার্থ প্রাপ্য।
মৃত্যুদন্ডের বিপক্ষে যুক্তি: অবশ্যই প্রতিটা মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার আছে এবং কারোর বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করাটা দন্ডনীয় অপরাধ। এতে কোন সন্দেহ নেই। দন্ড হিসেবে আপনি 30 বছর জেল দিতে পারেন। 30 বছর বন্দী থাকা মৃত্যুর চেয়ে বেশী ভয়ানক। এক বছর বন্দী থাকলেই মানুষ পাগল হয়ে যায়। কেউ বন্দী জীবন চায় না, খাচায় বন্দী পাখির জীবন কারোর কাম্য নয়। সবাই আকাশে উড়া পাখির মত মুক্তভাবে সমাজে চলে ফিরে বেড়াতে যায়। বন্দীত্ব কি আপনার কাছে কম শাস্তি মনে হয় নাকি ? এটা বিশাল ব্যাপার। ঠান্ডা মাথায় খুনীদের 30 বছর ও রাগের মাথায় যারা খুন করে তাদের 20 বছর কারাদন্ডের আইন করুন। এটাই যথেষ্ট।
অপরাধ বিজ্ঞানী সিজার বেকারিয়ার মতে, ''হত্যা একটা অপরাধ। সমাজ হত্যাকে ঘৃণা করে। কিন্তু হত্যার শাস্তি হিসেব সেই হত্যাই যখন রাষ্ট্র ঠান্ডা মাথায় কোন হত্যাকারীর উপর আরোপ করে তখন সেই সমাজকে সভ্য সমাজ বলা যায় না। জীবন কেড়ে নেবার অধিকার হত্যাকারীরও নেই, হত্যার বিচারকার্য পরিচালনা করা রাষ্ট্রেরও নেই। 
পক্ষে যুক্তি: মৃত্যুদন্ডের ফলে শুধু হত্যাই নয়, অন্য যেসব অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ডের বিধান আছে সেই অপরাধগুলো সহজে করবে না অপরাধীরা। মৃত্যুদন্ড খুন করতে ইচ্ছুক মানুষদের একটা ভীতির মধ্যে রাখতে সমর্থ্য হয়। মৃত্যুদন্ড আইন বাতিল হলে অপরাধপ্রবণ লোকদের সাহস বেড়ে যাবে এবং তারা বড় ধরনের অপরাধ করতে উৎসাহিত হবে।
বিপক্ষে যুক্তি: হত্যা হল সবচেয়ে বড় অপরাধ। যেখানে হত্যা করলেও হত্যাকারীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া যায় না। সেখানে অন্যান্য অপরাধের জন্য ( ধর্ষন, এসিড নিক্ষেপ ইত্যাদি ) মৃত্যুদন্ড দেয়ার তো প্রশ্নই উঠে না। শুরুতেই বলেছি - ভয় দেখিয়ে কাউকে কোন কিছু করা থেকে বিরত রাখা যায় না। মৃত্যুদন্ড কখনোই খুন করতে ইচ্ছুক মানুষদের ভীতির মধ্যে রাখতে সমর্থ্য নয়। ঈংল্যান্ডে রানী প্রথম এলিজাবেথের সময় পকেটমারের শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। জনসমক্ষে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার সময় সেই ভীড়ের মধ্যে পকেটমারেরা তাদের কাজ করত। পকেটমারদের ফাঁসী অন্য পকেটমারদের মনে কোন ভয়ের সঞ্চার করত না। যদি মৃত্যুদন্ড জিঘাংসাপ্রবণ মানুষদের মনে ভয়ের সঞ্চার করতে পারত তবে মৃত্যুদন্ড থাকা দেশগুলোয় অপরাধের হার কম হত। কিন্তু দেখা গেছে যেসব দেশে মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে সেসব দেশেই সবচেয়ে বেশী খুন হয়। আর যেসব দেশে মৃত্যুদন্ড নেই বা আইন খুব কঠোর নয়, ওসব দেশে খুন তো দূরের কথা যেকোন অপরাধ নেই বললেই চলে ( ইউরোপের দেশগুলো )। মৃত্যুদন্ড উঠিয়ে দিলে অপরাধপ্রবন লোকদের অপরাধ করতে উৎসাহ বাড়বে - এ ধারণা একেবারেই ভুল। এর জ্বলন্ত উদাহরণ কানাডা। কানাডা 1976 সালে মৃত্যুদন্ড তুলে নেয়। বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী কানাডায় খুনের হার 70% কমে গিয়েছে।
পক্ষে যুক্তি: বাংলাদেশের অতীতে বহু আলোচিত খুনী এরশাদ শিকদারের কথা কি আপনার মনে আছে প্রধাণমন্ত্রী ? সে ৬০ টি খুন করেছিল। ১ম ব্যক্তির হত্যাকান্ডের পর যদি তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হত তবে কি বাকি ৫৯ জন মানুষের জীবন রক্ষা পেত না ?
বিপক্ষে যুক্তি: এরশাদ শিকদারের ১ম খুনের পর তাকে মৃত্যুদন্ড না দিয়ে ২০ বছর কারাদন্ড দিয়ে রাখলেই হত। সে জেল থেকে বের হতেও পারত না, কাউকে মারতেও পারত না। 

খুনই হোক বা অন্য কোন অপরাধই হোক, অপরাধীকে বুঝাতে হবে যে - সে যেই কাজটা করেছে তা অন্যায়। অনেকে জেনেশুনেই অপরাধ করে। একটা কাজ খারাপ, অন্যায়, অপরাধ জেনেও সে এই কাজটা করে। এ ধরনের লোকদের বুঝিয়ে লাভ নাই যে কাজটা অপরাধ। তাছাড়া কিছু কাজ নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক হলেও বিভিন্ন দেশের আইনে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত থাকে ( যেমন - ধর্ম সমালোচনা )। এসব ক্ষেত্রে আইন নিজেই অন্যায় আইন। যেহেতু আইনের দৃষ্টিতে কোন কাজ অপরাধ হলেই সেটা নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অপরাধ হয় না সেহেতু যেটা বুঝাতে হবে সেটা হল - কাজটা অন্যায়। কেন অন্যায় ? সেটার পিছনেও লজিক দেখাতে হবে। শাস্তিদানের চেয়ে বেশী জরুরী অপরাধীকে এটা বুঝানো যে, তার কাজটা করা ঠিক হয়নি। শাস্তি বা জেল দিলে হতে পারে, জেল থেকে বের হয়ে সে আবার একই কাজ করছে। এজন্য তাকে অনুতপ্ত করানোটা শাস্তি দানের চেয়ে বেশী জরুরী। একবার বুঝিয়ে সুঝিয়ে অনুতপ্ত করাতে পারলে অপরাধী এমনিতেই ভবিষ্যতে উক্ত অপরাধটি করা থেকে বিরত থাকবে। তখন অন্য অপরাধীদের দৃষ্টান্ত দেখানো যাবে এই বলে যে - "তোমাদেরই একজন অপরাধ করে অনুতপ্ত হয়েছে, ভাল পথে ফিরে এসেছে। সে যদি পারে তবে তোমরা কেন পারবে না ?" দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে কখনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায় না। অপরাধীকে তার কাজের জন্য অনুতপ্ত করানোই সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত। সবচেয়ে বড় শাস্তি সেটাই, যেটা কখনোই দেয়া হয় না। না, আমি খুনী ধর্ষক এদের জেল দিতে মানা করছি না। এগুলো অনেক বড় অপরাধ। কিন্তু ছোটখাট অপরাধের ( যেমন - ব্যাঙ্ক ডাকাতি, ব্যাঙ্ক থেকে টাকা চুরি, নারী নির্যাতন, দুর্নীতি, ঘুষ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই ইত্যাদি ) জন্য শাস্তি কমিয়ে দিন। ছোটখাট অপরাধীদের অপশন দেয়া হোক। যেমন - ব্যাঙ্ক ডাকাতকে সময় দিবেন এক থেকে দেড় বছর। তার ডাকাতি করা সব টাকা ঐ সময়ের মধ্যে ফেরত দিলে আর জেল দেয়া হবে না। ফেরত দিতে না পারলে তখন জেল। আবার যদি কোন পুরুষ কোন নারীকে নির্যাতন ( শুধু শারিরীক ) করে বা কোন নারী কোন পুরুষকে নির্যাতন করে তবে তাকেও অপশন দিতে হবে - যাকে সে নির্যাতন করছে হয় তার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে হবে অথবা যাকে সে নির্যাতন করছে তার হাতে নির্যাতিত হতে হবে। নির্যাতনকারী যদি নির্যাতিত ব্যক্তিকে চড় থাপ্পড় মারে, তবে তাকেও নির্যাতিত ব্যক্তির চড় থাপ্পড় খেতে হবে। বেত্রাঘাত করলে, বেত্রাঘাত পেতে হবে। এরকম আরকি। যদি এই দুই অপশনে রাজী না হয় তখন জেল। এখন অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, শারিরীক নির্যাতনের শাস্তি শারিরীক নির্যাতন দিলে, খুনের শাস্তি মৃত্যুদন্ড দিলে সমস্যা কি ? মৃত্যুদন্ড অনেক বড় বিষয়। খুনের বদলে মৃত্যুদন্ড দিয়ে খুন করা যায় না। কেউ কারোর চোখ উপড়ে নিলে রাষ্ট্র তার চোখ উপড়ে নিতে পারে না, কেউ এসিড নিক্ষেপ করলে রাষ্ট্র তাকে শাস্তি হিসেবে এসিড নিক্ষেপ করতে পারে না। কারণ, এগুলো ভয়াবহ। কিন্তু শারিরীক নির্যাতনের জন্য সমপরিমান শারিরীক নির্যাতন শাস্তি হিসেবে দেয়াই যায়। শারিরীক নিরর্যাতনের চেয়ে জেল অনেক ভয়াবহ শাস্তি। আমি শাস্তি কমানোর পক্ষে। কিছু কিছু অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধীর সাথে সেই কাজ করা মানায় যে কাজ করে সে অপরাধী হয়েছে। কিন্তু সব অপরাধের ক্ষেত্রে এটা মানায় না। বুঝাতে পেরেছি ? 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন