মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০১৭

সৌরজগৎ অধীশ্বর ( ১ম পর্ব )

আমাদের সৌরজগতের অধীশ্বর সূর্য একটি নক্ষত্র। যুগযুগান্তর ধরে মানুষের সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলো সূর্য। জ্ঞানোন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন মানুষ অনন্ত বিস্ময়ে দেখল, রাত্রিশেষে পুবের আকাশ ক্রমশ লাল হয়ে ওঠে, আর প্রকৃতির বৃক থেকে অন্ধকারের কালো আবরণ ধীরে ধীরে সরে যায়। একটু পরেই লাল রঙের থালার মত সূর্য তার অপূর্ব বর্ণচ্ছটায় চারদিক উদ্ভাসিত করে তোলে। সঙ্গে সঙ্গে নিস্তব্ধ পৃথিবীর বুকে জেগে ওঠে প্রাণের সাড়া, চতুর্দিক পাখির কাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। অন্ধকার থেকে আলোর প্রকাশ, যা থেকে এক মুহুর্তে পৃথিবীর সবকিছুই সুন্দর ও প্রাণজঞ্চল হয়ে ওঠা এবং তা দেখে সাধারণ মানুষের অপার বিস্ময় ও অপূর্ব পুলকের সঞ্চার খুবই স্বাভাবিক। তাই, হিন্দু শাস্ত্রানুসারে সত্য ও সুন্দরের ধ্যাণে মগ্ন হওয়ার এটাই সবচেয়ে যথার্থ সময়।
আমাদের সবচেয়ে কাছের তারা সূর্য আসলে একটি জ্বলন্ত গ্যাসের পিণ্ড। এটি পৃথিবীর ব্যাসের ১০৯ গুণ বেশি এবং ভর সৌরজগতের সব গ্রহের মিলিত ভরের ৭৪৫ গুণ অধিক। পৃথিবী থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব ১৫২,১০০,০০০ কি.মি.। সূর্যের কোথাও কঠিন বা তরল পদার্থের অস্তিত্ব নেই। সূর্য আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্রবিন্দু। বাসভূমি পৃথিবীসহ আরো সাতটি গ্রহ এই মহান তারাটিকে কেন্দ্র করে আবর্তন করছে। সূর্যই আমাদের সকল শক্তির উৎস। আমাদের জগৎ জীবন সবকিছু এই দেবতাতুল্য বস্তুটির উপর নির্ভরশীল। 
 সূর্যের উৎপত্তি
বিগব্যাঙের পরে আজ হতে প্রায় ১৩৬০ কোটি বছর পূর্বে জন্ম নেয় আকাশগঙ্গা নামক একটি গ্যালাক্সি, যার কেন্দ্র থেকে ২৫০০০ আলকবর্ষ দূরে কালপুরুষ নামক বাহুতে ৫০০ কোটি বছর আগে বিশাল সুপারনোভা বিস্ফরণজাত গ্যাসের মেঘ থেকেই আমাদের সূর্যের জন্ম। মহাকাশে নক্ষত্রদের মাঝে থাকে বিশাল ব্যাপ্তি। এই ফাঁকা স্থানে থাকে অসংখ্য ধুলিকণা, হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ইত্যাদি।
কোনভাবে এই গ্যাসের মেঘ খুব ছোট জায়গায় ঘন হতে থাকে। ঠিক কিভাবে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়, সে ব্যাপারে জেমস্ জীনসের তত্ত্ব কিছুটা সাহারয্য করে। যখন মেঘটি মহাকর্ষীয় পতনের শিকার হয়, তখনই সেই মেঘ থেকে সূর্যের জন্ম সূচিত হয়। আদি মেঘটিকে অবশ্যই ঘূর্ণায়মান হতে হবে। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাই ঘটে। ৫০০ কোটি বছর পূর্বে কোন এক অতীতে এরকমই কোন গ্যাসের মেঘ মহাকর্ষ পতনের ফলে ঘূর্ণায়মান হয়ে উঠেছিল। সেই আদি মেঘের যদি কোন চৌম্বকক্ষেত্র থাকে তবে কেন্দ্রেই তা শক্তিশালী হবে। কারণ, সেখানে ভর বেশী। এভাবেই সেই গ্যাসীয় মেঘের কেন্দ্রে তৈরী হয়েছিল আমাদের নতুন সূর্য, যাকে বলা হয় ভ্রূণ সূর্য। তারপর এই ভ্রূণ সূর্যের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। এভাবে অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেলে হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসর প্রোটনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়। বিকর্ষণজনিত যে বৈদ্যুতিক বল প্রোটনগুলোকে বিচ্ছিন্ন রাখে, এই প্রচন্ড তাপশক্তি তা উপেক্ষা করে প্রোটনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দেয়। সংঘর্ষজনিত এ বলের প্রভাবে হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো গলে গিয়ে তৈরী করে হিলিয়াম। এভাবেই নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় সূর্যের চুল্লীতে দহন প্রক্রিয়া শুরু হয়। আরো দু’কোটি বছর পর আমাদের সূ্র্য দৃঢ় স্থির অবস্থায় উন্নীত হয়। নিউক্লিয়র বিক্রিয়ায় উদ্ভূত তাপের ফলে সৃষ্ট বহির্মুখী চাপ এবং মহাকর্ষজনিত অন্তর্মুখী টানের ফলে সাম্যাবস্থার সৃষ্টি হয়। পরবর্তী পাঁচশ কোটি বছর ধরে এখন পর্যন্ত আমাদের সূ্র্য এমনিভাবেই জ্বলছে এবং আরো পাঁচশ কোটি বছর জ্বলবে। 
 পুরো আকাশগঙ্গা ছায়াপথ নিজে আবর্তিত হচ্ছে। সে কারণে, সূর্যও নির্দিষ্ট গতিতে ছায়াপথের কেন্দ্র অনুসরণ করে ঘুরছে।এক্ষেত্রে সৌরজগতের ঘূর্ণায়মান গতি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২১৭ বছর। এ গতিতে সৌরজগৎ একবার সম্পূর্ণ আবর্তিত হতে সময় নেয় ২২৬,০০০,০০০ বছর। সূর্যের ব্যাস ১৩,৯১,১০৭ কি.মি. যা পৃথিবীর ব্যাসের ১১০ গুণ। এ থেকে পাওয়া যায় সূর্য পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল পৃথিবীপৃষ্ঠের ক্ষেত্রফলের ১২,০০০ গুণ এবং সূর্যের আয়তন পৃথিবীর আয়তনের ১৩ লক্ষ গুণ। আকারে বিশাল হলেও সূর্যে পদার্থের ঘনত্ব ১/৪ ভাগ, ফলে সূর্যের ভর পৃথিবীর ভরের ৩,৩০,০০০ গুণ, ২০৬০কি.গ্রা.। বিশাল ভরের দরুণ এর মহাকর্ষ বল পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশী, ২৭.৯ গুণ। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব ১৪ কোটি ৯৫ লক্ষ কি.মি.। সূর্য হতে এ বিশাল দূরত্বে পৃথিবীর অবস্থান হলেও সূর্যের প্রবল মহাকর্ষের টান পৃথিবীকে তার কক্ষপথে ধরে রেখেছে। 

 সূর্যের উপাদান
সূযের বহিস্তর ৭৩% হাইড্রোজেন, ২৫% হিলিয়াম, ২% অন্যান্য উপাদান দ্বারা গঠিত। কিন্তু যেখানে ৬০০০ লক্ষ টনেরও অধিক হাইড্রোজেন হিলিয়ামে পরিণত হয়ে চলছে প্রতিমুহূর্তে সেখানে হাইড্রোজেনের পরিমাণ প্রায় ৩৪% এবং হিলিয়ামি প্রায় ৬৪%। সূর্যেও কেন্দ্রীয় অংশে এভাবে হাইড্রোজেন, হিলিয়ামে রূপান্তরের ফলে শক্তি সৃষ্টি হচ্ছে। প্রসঙ্গত চারটি হাইড্রোজেন পরমানু (প্রোটন) মিলে একটি হিলিয়াম পরমাণু সুষ্টি হরছে। এ ছাড়া গামা রশ্মি নামক একগুচ্ছ বিকিরিত রশ্মি বা আলোককণার সঙ্গে পজিট্রন (.Positron.) ও নিউট্রিনো (.Neutrino.) নামক কণিকাও এ সময় নির্গত হয়। এ রূপান্তরের সময় শতকরা ০.০৭ ভাগ ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। ফলে প্রতি মুহূর্তে বিপুল পরিমাণে শক্তি ও উত্তাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
এ শক্তি সূর্যের কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে রওনা হয় গামা ও রঞ্জন রশ্মি রূপে। কেন্দ্রের প্রচণ্ড চাপের ফলে একবিন্দু শক্তির বাইরের দিকে আসতে প্রায় দশ থেকে কুড়ি লক্ষ বছর সময় লাগে। সূর্যেও পৃষ্ঠদেশ থেকে এ আলোকশক্তি পৃথিবীতে পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র ৮.৩ মিনিট।
ক্রমাগত সূর্যেও কেন্দ্রে এ তেজস্ক্রিয় বিক্রিয়ার ফলে যখন হাইড্রোজেনের পরিমাণ কমে আসবে তখন কিন্তু বিরাট সমস্যার সৃষ্টি হবে। কেন্দ্র তখন শুকিয়ে ছোট হয়ে আসবে ১/১০ ভাগ আগের আয়তনের তুলনায়। বাইরের স্তরগুলো উঠবে ফুলে। তাদের তাপমাত্রা অনেকখানি কমে আসবে এবং সূর্য পরিণত হবে লাল দানবে (.Red Giant.)। আরো হাজার কোটি বছর পরে যখন সূর্য লাল দানবে পরিণত হবে তখন তার উজ্জ্বলতা বর্তমানে তুলনায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে। এ অবস্থায় তার ব্যাস প্রায় বর্তমানের তুলনায় ১০০ গুণ বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে সূর্যের কাছে অবস্তিতত গ্রহগুলোর ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠবে। সম্ভবত এ অবস্থায় সূর্য বুধ, শুক্র ও পৃথিবীকে গ্রাস কওে মঙ্গলে এসে উপস্থিত হবে। অবশ্য এ ঘটনা নিয়ে এখনই চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। কেন না, সূর্য তার হাইড্রোজেন জ্বালানির শতকরা একভাগ মাত্র এ পর্যন্ত খরচ করেছে। এমন ঘটনা ঘটবে ৫০০ কোটি বছর পর।

সূর্যের গঠন
সূর্যের গোটা শরীরটা এক ধরণের নয়। সূর্যকে গঠনের বৈচিত্র্য অনুযায়ী তিনটি অংশে ভাগ করা যেতে পারে, যথা- কেন্দ্রমন্ডল(Center Zone), মধ্যাঞ্চল(Interior), পরিচালন মন্ডল(Convection Zone), আবাহমন্ডল(Solar Atmosphere). আবাহমন্ডলকে আবার চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- আলোকমন্ডল(Photosphere), স্বল্প তাপমাত্রা অঞ্চল (Temperature minimum), বর্ণমন্ডল(Chromosphere) ও ছটামন্ডল(Corona)। 
পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডল আছে আমরা জানি। সূর্যের চারদিকে তেমনই আছে একটা গ্যাসের আবরণ, এ আবরণটি কম ঘনত্বের গ্যাসের দ্বারা আবৃত।
ক্রোমোস্ফিয়ারের উপরে এবং মহাশূন্যে লক্ষ লক্ষ কি.মি. ব্যাপী ¯বিস্তৃত অঞ্চল হলো এ করোনা। এটি সূর্যের আবহমন্ডলের সবচেয়ে বাইরের অংশ। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ঠাণ্ডা বলে নিস্প্রভ। সূর্যের অপাবরণটি অত্যন্ত উত্তপ্ত। মনে হয় সর্বদাই জ্বলছে। এ অংশের তাপমাত্রা প্রায় ১০ লক্ষ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। তবে কখনো কখনো এ অঞ্চলটিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে ৩০ লক্ষ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের উপরেও উঠে যায়। এত তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও করোনার উজ্জ্বলতা খুম কম। এর কারণ হলো এ অঞ্চলের গ্যাসীয় স্তর খুবই পাতলা। এর বিস্তৃতি প্রায় ৩.৬ কোটি মাইল, বুধগ্রহের কাছাকাছি পর্যন্ত।
সূর্যের এ করোনা অংশ থেকে প্রবাহমান আলোকের উচ্চগতিসম্পন্ন কণিকাসমূহকে বলা হয় সৌর বাতাস বা সোলার উইন্ড (.Solar Wind.)। এটা ইলেকট্রন ও প্রোটন কণিকা ছাড়াও আরও নানা প্রকার কণিকা দ্বারা গঠিত এবং এগুলো চৌম্বকক্ষেত্র ও তড়িৎপ্রবাহ সৃষ্টি করে থাকে। এটি হেলিয়োস্ফিয়ার (.Heliosphere.) নামক একটি অঞ্চলকে প্রভাবিত করে থাকে, যার ¯বিস্তৃতি সূর্য থেকে ১৫ বিলিয়ন কিলোমিটার। সৌরবাতাস প্রতি সেকেন্ডে ৩০০-৮০০ কিলোমিটার বেগে পৃথিবীর ওপর দিয়ে বয়ে যায। মাঝেমধ্যে কোটি টন গ্যাসের তৈরি বুদবুদ করোনা থেকে বিস্ফোরিত হয়ে কম্পন তরঙ্গের মাধ্যমে সৌরবাতাসে প্রেরিত হয়। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র সৌরবাতাসের অনেকটাই শনাক্ত করতে পেরেছে।
পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ মেরুদেশীয় অঞ্চলে আমরা সে মেরুজ্যোতি বা আরোরা (.Aurora.) দেখতে পাই তার প্রধান কারণ হলো এ সৌরবাতাস। আরোরা বা মেরুজ্যোতি দেখা যায় যখন সৌরবাতাস কণিকাসমূহ পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে আবদ্ধ হয়ে যায় এবং বায়ুমণ্ডলের উচ্চ অংশ বাতাসের অনুগুলোর সঙ্গে আবদ্ধ হয়। মেরুজ্যোতি মেরুপ্রদেশের আকাশে প্রদর্শিত হয় বিভিন্ন প্রকার রঙিন আলোকের এক অপররূপ প্রদর্শনী।
করোনার ভেতর দিকে অর্থাৎ দ্বিতীয় স্তরে রযেছে ফোটোস্ফিয়ার, বা আলোকমণ্ডল। সূর্যের আলোকমণ্ডল বলতে বোঝায় আমরা খালি চোখে সূর্যের যে অতি উজ্জ্বল আলোকময় অংশ দেখতে পাই সেটা। এ আলোকমণ্ডলে গ্যাসীয় বায়ুর ঘনত্ব খুবই কম। ৫০০ কিলোমিটার পুরু আলোকমণ্ডলের ভেতর থেকে অস্বচ্ছ, উত্তপ্ত জ্বলন্ত গ্যাস উঠে এস বাইরে মিলিয়ে যাচ্ছে। এর কেন্দ্রের ঘনত্ব পানির ৯০ গুণ আর লোহার ১২ গুণ। গ্যাসীয় বস্তু সেখানে ইস্পাতের মত কঠিন অবস্থায় রয়েছে। এ আলোকণ্ডলের তাপমাত্রা নিচ থেকে উপরে ক্রমশ হ্রাস পায়। এখানকার অংশে তাপমাত্র ৮৫০০০ সেন্টিগ্রেড থেকে হ্রাস পেয়ে উপরি অংশে তাপমাত্রা ৪২০০০ সেন্টিগ্রেডে এসে পৌঁছায়। তবে আলোকমণ্ডলে গড় তাপমাত্রা প্রায় ৫৫০০০ সেন্টিগ্রেড। দুপুরের রোধে দাঁড়ালে আমাদের গায়ে তাপ লাগে। তা হলেই বোঝা যাচ্ছে সূর্যের তাপটা কত ভয়ঙ্কর। আকাশে জ্বলন্ত সূর্য থেকে যে তাপ ছড়িয়ে পড়েছে, তার ২৩ কোটি ভাগের ১ ভাগ মাত্র আমাদের পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়। তাতেই এত তাপ। সারা পৃথিবীতে সূর্য থেকে একসঙ্গে যে তাপ এসে পৌঁছায় তা একত্রে জমা করতে পারলে এক মিনিটের মধ্যেই দশ লক্ষ মণ পানি ফুটে উঠত বলে বিজ্ঞানীদের অনুমান।
সূর্যের উপরিতল বা আলোকমণ্ডল জটিল কম্পনের আকৃতি অনুযায়ী ওঠানামা করে, একে বলা হয়, সোলার অসিলেশনস (.Solar Ocillations.)। কম্পন বা অসিলেশনের বেশিরভাগই হয়ে থাকে শব্দ কম্পনের জন্য যা উৎপন্ন হয় কনভেকটিভ জোন (.Convective Zone.) এর নিচে এবং সূর্যের অভ্যন্তরেই আবদ্ধ তেকে যায়। বিজ্ঞানীরা মনোযোগ সহকারে আলোকমণ্ডলের এ কম্পনের গঠন প্রকৃতির মানচিত্র অঙ্কনের মাধ্যমে সূর্যের অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে জানতে পারেন।
কিছু কিছু সোলার অসিলেশনস আবার ‘সান কয়েকস’ (.Sunquakes.) বা সৌর কম্পন-এর ফলেও হতে পারে। এ কম্পন তরঙ্গগুলো ছড়িয়ে পড়ে সূর্যের অশান্ত উত্তপ্ত গ্যাসের প্রান্ত থেকে যা কনভেকশন সেল (.Convection Cell.) নামে পরিচিত। ১.২ বিলিয়ন টন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরকের বিস্ফোরণের ফলে উৎপন্ন শক্তি এ কম্পন তরঙ্গের দ্বারা বাহিত শক্তির সমান হয়ে থাকে।
আলোকমণ্ডলের উপর কালো কালো অনেকগুলো দাগ ও জায়গা রয়েছে। এ দাগগুলো পৃথিবী থেকে সাধারণ দূরবীন (তবে, কখনোই ফিলটার ছাড়া খালি দূরবীনের মাধ্যমে নয়) দিয়েও দেখা যায়। এগুলোকে কালো দেখাবার কারণ আশোপাশের এলাকাগুলোর তাপমাত্রা কিছুটা কম এবং এগুলো উজ্জ্বল বেষ্টনী দ্বারা আবদ্ধ। তবে এরা কিন্তু স্থির থাকে না। সূর্যদেহের ওপর চলে ফিরে বেড়ায়। এদের নাম সৌর কলঙ্ক (.Sunspot.)। এ কলঙ্কগুলো দুটি শ্রেণীযুক্ত হয়। এর মধ্যে যেগুলো ছোট দাগযুক্ত অঞ্চল যা প্রায় ১০০০ কিলোমিটারেরও কম অঞ্চল জুড়ে ¯বিস্তৃত সেগুলো ‘’পোরস্’’ (.Pores.) নামে পরিচিত। আবার যেগুলো একসঙ্গে অনেকগুলো সমষ্টিবদ্ধভাবে রয়েছে তাদের বলা হয় সানস্পট গ্রুপ (.Sunspot Group.)। এগুরো প্রায় ১ লক্ষ কিলোমিটার ব্যাপী বিস্তৃত হয়ে থাকে।
 এ সৌর কলঙ্কের উৎপত্তি নিয়ে নানারকম মত আছে। যেমন-অনেকে বলেন নিজের অক্ষের চারপাশে সূর্যের যে গতিবেগ, সূর্যের দেহের সর্বত্র তা সমান নয়। নিরক্ক্ষরেখার ওপরের অংশে একবার ঘুরতে সময় লাগে ২৪ দিন ১৬ ঘণ্টা, চল্লিশ ডিগ্রি উত্তর বা দক্ষিণ অক্ষাংশে এ সময় লাগে ২৭ দিন আর মেরু অঞ্চলে এ ঘূর্ণনের সময় লাগে আরো বেশি অর্থাৎ প্রায় ৩৫ দিন। সূর্য যে ঘনীভূত পদার্থ নয়, উত্তপ্ত গ্যাসীয় বস্তু, এ থেকেই তা সহজে বোঝা যায়। ফলে সূর্যের গ্যাসীয় এ বস্তুর মধ্যে এক বিপুল আলোড়নের সৃষ্টি হয়। এ আলোড়নের ফলে সূর্যের নিজস্ব চৌম্বক ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন ঘটে, যার প্রকাশ এ সৌরকলঙ্কগুলো।
সূর্যের আলোকমন্ডলে খুব বেশি তাপের ফলে জ্বলন্ত বাষ্প অতি দ্রুতবেগে ধাবিত হয়ে প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝা বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে সূর্যের আলোকমণ্ডলের আগুনে বাষ্পের কিছু অংশ এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ে। বিস্ফোরণের ফলে এটা ঘটে বলে ধারণা করা হয়। আলোকমন্ডলের ফাঁক দিয়ে তখন সূর্যের সে ছটায় কালো কালো দাগ ফুটে ওঠে। একালো দাগগুলো সর্বোচ্চ ৮০০০ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত হতে দেখা যায়, এর কেন্দ্রের গভীর কলো অংশকে বলা হয় প্রচ্ছায়া(Umbra) আর একে ঘিরে যে হাল্কা ছায়া দেখা যায় তকে বলে উপচ্ছায়া(Penumbra)।এদের কতকগুলো আবার বিরাট বিরাট গর্তের সৃষ্টি করে। গর্তগুলো এত বড় যে তা দু-তিনটে পৃথিবীর সমান। তবে এরা বেশিদিন স্থায়ী হয় না। কোনোটি স্থায়ী হয় কয়েকদিন মাত্র আবার কোনোটা কয়েকমাস স্থায়ী হয়ে থাকে। সৌরকলঙ্কগুলো পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে সরে যেতে থাকে। নিরক্ষবৃত্তের কাছে সূর্যেও যে বহুদিন স্থায়ী সৌরকলঙ্ক রয়েছে তা পূর্বদিক থেকে সরে সরে পশ্চিমদিকে অদৃশ্য হয়ে গেলেও কিছুদিন পরে আবার তাকে পূর্ব প্রান্তেও দিকে দেখা যায়। প্রতি মাসে সর্বোচ্চ প্রায় ১২০টি সৌরকলঙ্ক সূর্যপৃষ্ঠে দেখা যায়। এ সংখ্যা সর্বনিম্ন প্রায় ৬টিতে নামতে পারে।
 সৌরকলঙ্কের সংখ্যা যে বছর বৃদ্ধি পায় তখন কিন্তু পৃথিবীতে গ্রীষ্মের তীব্রতা বেড়ে যায়। বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে ওপরের স্তর তড়িৎভাবাপন্ন হয় আর ভূপৃষ্ঠে চুম্বক ঝড়ের প্রকাশ দেখা যায়। এর ফলে টেলিগ্রাফ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, বেতার বার্তা প্রেরণ প্রভৃতির কাজেও মাঝে মাঝে ব্যাঘাত ঘটে থাকে।সৌরকলঙ্কের সংখ্যা যেবছর বৃদ্ধি পায় সে বছর সৌর শিখা বা সোলার ফ্লেয়ার (.Solar Flare.) এবং সৌর ঝড় এর দাপট বৃদ্ধি পায়।
১৮৫৯ সালে দুই বিজ্ঞানী রিচার্ড সি ক্যারিংটন ও রিচার্ড হাজসন সোলার ফ্লেয়ার বা সৌরশিখার কোঁজ পান। কিন্তু কেন হয় এ সৌরঝড় ও সৌরশিখা? সূর্যেও আবহমণ্ডল বা তার চারদিকেও গ্যাসীয় পর্দার পাশে জমে ওঠা চৌম্বকশক্তি হঠাৎ করেই ছিটকে বেরিয়ে আসে। এর ফলে যে বিকিরণ হয় তার শক্তি বা ক্ষমতাও সাধারণের কল্পনার বাইরে কয়েক লক্ষ মেগাটন হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণের সমতুল্য। সূর্য থেকে চৌম্বকমক্তি যত বিকিরিত হতে থাকে ততই অগুনতি ইলেকট্রন, প্রোটন আর ভারী নিউক্লিয়াস উত্তপ্ত হতে থাকে। ক্রমশ তাদের গতিবেগ বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে তা সূর্যের আবহমণ্ডলে ছিটাকে বেরিয়ে আসতে থাকে।


সান ফ্লেয়ার বা সৌরশিখা দেখতে পাওয়া যায় সৌর নিরক্ষরেখা করোনার ভিতর। সৌর নিরক্ষরেখার চারিধারে করোনা অনেকটা লুপ বা ফাঁসের মত, অংশটির নাম অ্যাক্টিভ রিজিয়ন। অ্যাক্টিভ রিজিয়ানের মধ্যেই সৌরশিখার অবস্থান। বিজ্ঞানীদের মতে সূর্যের মধ্যে চৌম্বক ক্ষেত্রে পরিবর্তন হলেই সৌরশিখার সৃষ্টি হয়। আবার সে অ্যাক্টিভ রিজিয়নেই ইলেকট্রিফায়েড ও ম্যাগনেটাইজড বা তড়িতাহত ও চৌম্বকাহত গ্যাস (প্লাজমা) রয়েছে। এগুলো খুব ভালো পরিবাহী। সে প্লাজমার ছিটকে বেরিয়ে আসার ঘটনার নাম ‘’করোনাল মাস ইজেকশান’’।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন