শনিবার, ১৯ জুলাই, ২০১৪

বিজ্ঞানশিক্ষা বনাম বিজ্ঞানমনস্কতা

বিজ্ঞানশিক্ষা কি জিনিস - সেটা আমরা সবাই জানি, কিন্তু বিজ্ঞানমনস্কতা কি - সেটা বোধহয় সবাই জানি না। তাই সে বিষয়ে আগে সূত্রপাত করা প্রয়োজন। বিজ্ঞানমনস্কতা হল সকল প্রাকৃতিক ঘটনার বৈজ্ঞানিক কারণ অনুসন্ধান করার মানসিকতা। এই জিনিসটা অবশ্যই সকল মানুষের মধ্যে Specially বিজ্ঞানের ছাত্রদের মধ্যে থাকা উচিত কিন্তু নাই। আজও আমরা অলৌকিক ঘটনায় বিশ্বাস করি, বোকার মত বিশ্বাস করি যে সবকিছুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান করা মানুষের পক্ষে সম্ভব না। বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার প্রথম এবং প্রধান শর্ত হল এটা বিশ্বাস করা যে, ''জগতে কোনকিছুই অলৌকিক নয়, কোনকিছুই মানববুদ্ধির অগম্য না, সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনারই বৈজ্ঞানিক কারণ আছে। হয়ত আমরা এখনো সবকিছু আবিস্কার করতে পারি নাই, ভবিষ্যতে করব।'' আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে একদিকে বিজ্ঞানের ছাত্রটি কুসংস্কারাচ্ছান্ন,অপরদিকে সাহিত্যের ছাত্রটি মুক্তমনা-এমন দৃশ্যপট মোটেও ব্যতিক্রম নয়। অর্থাৎ একজন বিজ্ঞানের ছাত্র হলেই যে সে বিজ্ঞানমনস্ক হবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। বরং নিউটন-আইনস্টাইন পড়েও একজন বিলক্ষণ যুক্তিহীন হয়ে গড়ে ওঠে, প্রাণীবিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও একজন বিশ্বাস করেন ''বিবর্তনবাদ'' একটি ভুয়া মতবাদ-এমনটাই আমাদের দেশের স্বাভাবিক দৃশ্য। হুমায়ূণ আজাদের মত মানুষ বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক হয়েও বিজ্ঞানমনস্কতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন আমাদের দেশের বিজ্ঞান ও প্রকৌশল শিক্ষার ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে ততখানি বিজ্ঞানমনস্কতা,কিংবা বিজ্ঞানমনস্কতাকে প্রতিষ্ঠিত করার সাহস কোনটাই খুব একটা দেখা যায় না। আমাদের প্রথম ও প্রধান মানসিক বৈকল্য হচ্ছে আমরা কোন কিছু জানার আগেই নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে ফেলি(বা ফেলানো হয়);এরপর যে যে বিষয় বস্তু ঐ ঐ বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক সেগুলোকে আমরা অস্বীকার করি কিংবা অবাস্তব/অসম্ভব দাবি করি। অথচ এই দাবিটি করছিই আমরা একটি অযৌক্তিক কে ভিত্তি করে। সমস্যাটা হচ্ছে,আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এই অযৌক্তিক কে নির্মূল করা তো দূরে থাক,প্রকারান্তে এই অবাস্তব assumptionকেই প্রতিষ্ঠিত করে মুক্তচিন্তার পথকে বাধাগ্রস্ত করছে। এক কথায় বিজ্ঞানের মূল উৎস যেখানে, ‘কি কেন এবং কিভাবে’ এই প্রশ্ন করা কিংবা কার্যকারণ অনুসন্ধান করা-এই বেসিক বিষয়ে বিস্মৃত রেখে আমাদেরকে বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।ফলে নিউটনের সূত্র টপাটপ গলধঃকরণ করে কিংবা পাঠ্যবইয়ের বাইরেও জ্ঞান আহরণ করার পরও আমাদের মধ্যে যুক্তিবোধ জাগ্রত হচ্ছে না।কারণ আমাদেরকে চিন্তা করানো শিখানোই হয়েছে ভুল একটা পদ্ধতিতে। ভুলভাবে চিন্তা করার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে আমাদেরকে এই শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। বিজ্ঞান কি? আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি গুলে খাওয়া কিংবা ফ্লুইড মেকানিক্সের নেভিয়ার স্ট্রোক ইকুয়েশনে প্যাশনেট হওয়া কিংবা অয়লারের কঠিন গাণিতিক তত্ত্বে পারদর্শী হওয়াই কি বিজ্ঞান? আমি অনেক ফিজিক্স জানি,গণিতের পোকা-তাতেই কি আমার বিজ্ঞান শিক্ষা সার্থক হয়ে গেল? আমার উত্তর হচ্ছে না। বিজ্ঞান হচ্ছে একটা দর্শন,যে দর্শনের মূল ভিত্তিটাই হচ্ছে প্রশ্ন করা,কার্যকারণ অনুসন্ধান করা। সেই প্রশ্ন করা আর সত্যান্বেষণ করার চেতনা বা মানসিকতা যদি আমার মধ্যে তৈরি না হয় তবে হাজার হাজার বই পড়ে আমি হয়তো জ্ঞানী হতে পারবো কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারবো না। আর বিজ্ঞান পড়ে যদি বিজ্ঞানমনস্কই হতে না পারি, তো কি লাভ এত জ্ঞানী হয়ে ? কি লাভ এত সার্টিফিকেট আর ডিগ্রি নিয়ে ? সমস্যাটা হল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখন marks and money সিনড্রোমে ভুগছে- . লেখাপড়ার মূল উদ্দেশ্য ভাল নম্বর পাওয়া এবং শিক্ষাজীবন শেষে ভালো বেতনের চাকরি পেয়ে সুন্দরী বউ ঘরে তুলে সংসারী হওয়া-এটাই হচ্ছে ভেতো বাঙ্গালির কমন জীবন দর্শন,কিংবা আরেকটু বাড়িয়ে বলা যায়,এটিকেই বাঙ্গালি জীবনের সর্বোচ্চ সার্থকতা(মতান্তরে সাফল্য) হিসাবে বিশ্বাস করে। এই সমস্যার উদ্ভব আমাদের সমাজের প্রচলিত কিছু সংস্কার থেকে।ছোট থেকে আমাদের শেখানো হয় গুড বয় হতে।গুড বয়ের সংজ্ঞা কি? যে বিনা বাক্যব্যয়ে সব মেনে নেয়,কথার বিপরীতে পালটা যুক্তি দেয় না, এমনকি প্রতিবাদও করে না। প্রতিবাদ করাটা এক অর্থে আমাদের গুরুজনদের কাছে অভদ্রতার প্রতীক,রীতিমত যেন এক ঝামেলা। গায়ে কাদা না লাগিয়ে সাক্ষী গোপাল হিসেবে একটা কুপমন্ডূক জীবন কাটিয়ে দিতে পারলেই বাঙালি মহাখুশি। রবীন্দ্রনাথ বোধহয় এজন্যই বলেছিলেন-‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন’!!! কিংবা নজরুলের শেষ ভাষণের এই বাক্যটির কথাই ধরা যাক-‘আমাকে বিদ্রোহী বলে খামোখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এই নিরীহ জাত টাকে আচড়ে কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচার এর বিরুদ্ধে।'' তিনি শুধু অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন নি,প্রতিবাদ করেছিলেন এই সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে,প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন আমাদের ঘুনে ধরা প্রাচীন অর্বাচীন চিন্তা-ধারার বিরুদ্ধে।তাই তিনি হয়ে পড়লেন বেয়াদব,শয়তান, ‘শান্তি’ বিনষ্টকারী। এখন অবশ্য বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে যারা অতি সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মান্ধ তাদের কাছে নজরুলই হচ্ছেন একমাত্র যক্ষের ধন রবীন্দ্রনাথ নামক মালাউনের বিপরীতে!!!! এক মালাউনের লেখা গান কেন আমাদের জাতীয় সংগীত তা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাকা চৌধুরী জাতীয় সংসদে বসেই ব্যাপক আহাজারি করেছিলেন।তখন কিন্তু নেহায়েৎই শিক্ষিত শ্রেণীর কিছু সাহসী মানুষ ব্যতীত আপামত জনগোষ্ঠীর মধ্যে আহামরি কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি,কারণ প্রতিক্রিয়া দেখানোটা আমাদের সমাজে অভদ্রতা,যদি সেটা হয়ে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তাহলে তো কথাই নেই। একারণে তথাকথিত নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীগণ আর টকশো এর বুদ্ধিজীবীগণ তাদের দেশ উদ্ধারের বক্তৃতায় এ বিষয়গুলোতে নীরব থাকেন। ঈশ্বরচন্ত্র বিদ্যাসাগর সমাজ সংস্কারক, সাহিত্যের মানুষ, বিজ্ঞানী নন। অথচ তিনি গ্রামে গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন শিশুদের।শিখিয়েছে আহ্নিক গতি বার্ষিক গতির ব্যাপার স্যাপার। অকপটে বলেছেন কোন রথের চাকায় ভর করে সূর্য যাতায়াত করে না,বলেছেন সূর্য পৃথিবীর নিচে কোথাও গিয়ে চোখ বুজে ঘুমায় না। এই হচ্ছে বিজ্ঞান শিক্ষা,এই হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্কতার সূচনা। এই কাজটি তিনি করেছিলেন কারণ তিনি বিজ্ঞানমনস্ক ছিলেন, যে বিজ্ঞানমনস্কতার ধার ধারেন না আমাদের ফিজিক্স কেমিস্ট্রি জুলজি বা প্রকৌশলীর শিক্ষকগণ। আমি একজন বিজ্ঞানমনস্ক ব্যাক্তি। এইজন্যই যখন দেখি যে, আমার কোন গণিত বা ফিজিক্সের শিক্ষক মানবজাতির উৎপত্তির ক্ষেত্রে সেই আদিপিতা-আদিমাতার গাঁজাখুরি থিওরীতে বিশ্বাস করে এবং আফসোস করে বলে, ''ইশ্, কেন যে তাহারা শয়তানের কথায় বেহেশ্তের ঐ বিশেষ ফল খেতে গিয়েছিল। তারা ঐ ভুলটা না করলে আমরা কত মজা করে স্বর্গে বসে স্বর্গীয় সুখ ভোগ করতাম; আমাদের এত কষ্ট করে ফিজিক্স ম্যাথ শিখতে হইত না, এত বাঘা বাঘা Equation জানতে হত না। সর্বোপরি পৃথিবীর মত কষ্টদায়ক জায়গাতে আসতে হইত না।'' তখন আমারই আফসোস হয় তেনাদের কথাবার্তা শুনে। মনে হয়, ''এ কাদের কাছে আমি পড়ছি, কাদের কাছ থেকে বিদ্যা অর্জন করছি ?'' বর্তমানকালের একজন জনপ্রিয় পদার্থবিজ্ঞানী ব্রায়ান গ্রীণ বলেছেন, ''আমার প্রকৃত শিক্ষক কখনোই তারা নয় যারা আমার সকল প্রশ্নের উত্তর জানে, আমার প্রকৃত শিক্ষক তারাই যারা সত্যিই খুবই আগ্রহী সেইসকল অজানা প্রশ্নের উত্তর জানতে।'' এটা আমারও মনের কথা। কিন্তু আমার Bad Luck. আজ পর্যন্ত আমি আমার মনের মত কোন শিক্ষক পেলাম না।

1 টি মন্তব্য:

  1. অনেক ভাল লেখা। আমার কিছু প্রশ্ন আছে। বিজ্ঞানমনষ্কতা শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ কী? আর এখানে বিজ্ঞানমনষ্কতা শব্দটির যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তার উৎস্য কী?

    উত্তরমুছুন